১(সেন্টিনেল আইল্যান্ড, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ) আমি
নিবু, আজ আমার অনেক আনন্দের দিন। আমি জীবনে প্রথম বারের মত একটা বন্য শুকর
নিজের হাতে শিকার করে এনেছি। অনেকদিন ধরে আমার সর্বশেষ বাবা তীরু আমাকে
তীর ধনুক চালনা শেখাচ্ছিলেন। শিকার করবার দক্ষতা অর্জন করায় আমাদের
পৃথিবীতে মাত্র দশ আঙুল আর দুই আঙুল (১০+২=১২) চক্র সময়ে আমি আজ পূর্ণ
মর্যাদার সবল মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছি।
চক্র হচ্ছে
আমাদের পৃথিবীর সময়ের হিসাব। আমরা জানি অনেকটা সময় পর পর প্রকৃতিতে একই রকম
পরিবর্তন আসে। এক সময় সূর্য দেবতা উত্তরে হেলে থাকেন, একসময় দক্ষিণে,
আবার কখনো দিনের মধ্যভাগেও সূর্য দেবতা সরাসরি মাথার উপর থাকেন। দ্বীপের
মধ্যভাগে পাহাড়ের ছায়া যেদিন অপর পাশে একটা বড় পাথর স্পর্শ করে, সেদিন থেকে
আমরা বুঝতে পারি যে নতুন চক্র শুরু হচ্ছে। আজকে আমার শিকার করা বন্য শুকর
সবাইকে ভাগ করে খাওয়ানো হবে, সাথে অনেক অনেক মজাদার খাবার তো থাকবেই।
আমাদের প্রধান খাদ্য হচ্ছে মাছ, বন্য প্রানী এবং নানা গাছের শেকড় আর ফলমূল।
আজকে আমাদের পৃথিবীর দশ আঙুল দশ আঙুল দুই আঙুল আর আলাদা চার আঙুল (
১০X১০X২+৪ = ২০৪ জন ) মানুষের সবাই উপস্থিত থাকবে আমার জন্য।
আমাদের
পৃথিবীতে মানুষ দুই ধরনের। এক ধরনের মানুষ নতুন মানুষ জন্ম দিতে পারে, ওরা
একটু দুর্বল হয়। তাদের আমরা বলি দুর্বল মানুষ। আরেক রকমের মানুষ সন্তান
জন্ম দিতে পারে না। তবে ওরা বড় হলে শক্তিশালী হয়, শিকার করতে শেখে। তাদের
আমরা বলি সবল মানুষ। সবই সূর্য দেবতা সাংরার ইচ্ছা। তার ইচ্ছাতেই দুর্বল
মানুষেরা প্রায় সমান হারে দুই রকমের মানব সন্তান তৈরী করতে পারে। আমাদের
পৃথিবীতে সবল মানুষেরা দুর্বল মানুষের উপর তখনই অধিকার পায় যখন আমাদের
মধ্যের সবল মানুষদের কেউ কমপক্ষে দশ আঙুল আর পাঁচ আঙুল (১০+৫=১৫) চক্র সময়
বয়সের কোন দুর্বল মানুষের উপর অধিকার পাওয়া সবল মানুষকে কুস্তি লড়াইয়ে
পরাজিত করতে সক্ষম হয়। সবল মানুষদের কোন দুর্বল মানুষ পছন্দ থাকলে সেটা
মহান সবল মানুষ থিরুকে জানাতে হয়। উনি আমাদের পৃথিবীর সব মানুষের যেকোন
ব্যাপারে একক সিদ্ধান্ত দেন। উনি সম্মতি দিলে সেই দুর্বল মানুষ রাজী না
থাকলেও তাকে সেই সবল মানুষের সাথেই থাকতে হয়। মহান সবল মানুষ থিরুর সঙ্গী
বেছে নেবার ব্যাপারে কোন নিয়ম নেই। উনি যখন ইচ্ছা যেকোন দুর্বল মানুষকে
সঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে পারেন।
সূর্য দেবতা ঘুমাতে যাবার আগে যখন
সাগরমাতার সিরির শেষ সীমানা থেকে অল্প কিছু উপরে ছিলেন তখন তাদের উৎসব শুরু
হলো, সব সময়ই তাই হয়। অন্যদের কাছে তার শিকার করা বন্য শুকরটা নয়, বরং
সাগরমাতার বুক থেকে বড় এক কচ্ছপ তাদের পৃথিবীতে চলে এসেছিলো, সেটাই আজকের
প্রধান আকর্ষন। এগুলোকে সাগরমাতা সিরির বুকে থাকা অবস্থায় ধরবার চেষ্টা করা
নিষেধ। যারা চেষ্টা করেছে সাগরমাতা এমন কচ্ছপ সহ তাদের নিজের বুকে টেনে
নিয়ে গেছেন রেগে গিয়ে। তবে সাগরমাতা অনেক মহান। তিনি আমাদের খাদ্য দেন।
মাঝে মাঝে আমাদের পৃথিবীর উপরে পাঠিয়ে দেন রসালো এই কচ্ছপদের। উপরে উঠে এলে
তাদের সহজেই ধরা যায়, এ ব্যাপারে নিষেধ নেই মহান সবল মানুষের। এসব কথা
আমাদের মহান সবল মানুষ থিরু আগের মহান সবল মানুষদের কাছ থেকে জেনেছেন।
আমাদের
পৃথিবীর বাইরে সাগরমাতার শেষ প্রান্তে থাকে সাদা চামড়ার অভিশপ্ত মানুষেরা।
সূর্য দেবতা সাংরার অভিশাপে তাদের চামড়া নষ্ট হয়ে গিয়ে সাদা ফ্যাকাশে হয়ে
গেছে। তাদের মনে অনেক হিংসা। তারা চায় না এই পৃথিবীর মানুষেরা ভালো থাকুক।
মাঝে মাঝে তারা গাছের ফাঁপা খোলের মত কিছু একটায় চড়ে তাদের পৃথিবীর
প্রান্তে চলে আসে। তারা আমাদেরকেও অভিশপ্ত করতে লোভ দেখায়। মাছ আর নানা
অদ্ভুত জিনিস ছুঁড়ে ফেলে আমাদের দিকে। কিন্তু আমরা এই লোভের ফাঁদে পা দেবার
পরিণতি সম্পর্কে জানি। একবার আমাদের পৃথিবীর প্রান্তে ভেসে ভেসে এক
অভিশপ্ত মানুষ চলে এসেছিলো। মায়া করে তাকে খাবার দাবার দিয়ে সুস্থ্য করবার
চেষ্টা করেছিলো সবাই। কিন্তু সে এমন অবাধ্য ছিলো যে কোন খাবারই মুখে তুলতে
চায়নি। এমনকি কচ্ছপের মাংসও না! সেই অহংকারী অভিশপ্ত মানুষকে সাহায্য করবার
পরিণতি হিসেবে আমাদের উপর শাস্তি নেমে আসে। সূর্য দেবতা আমাদের পৃথিবীর
বেশিরভাগ মানুষের শরীরের উত্তাপ বাড়িয়ে দেন। প্রায় অর্ধেক মানুষই মারা যায়
আমাদের পৃথিবীর। এই সাদা অভিশপ্ত নষ্ট চামড়ার মানুষদের সংস্পর্শে এলে এমন
পরিনতির অনেক কাহিনী আমরা বয়স্কদের মুখে শুনতে পাই। তাই তারা কেউ এলেই
তাদের তীর ছুঁড়ে তাড়িয়ে দেয়া হয়।
আমাদের পৃথিবীতে অভিশপ্ত মানুষদের প্রবেশ নিষেধ!
২উৎসব শুরু হয়েছে মহান সবল মানুষ থিরুর গুহার ঘরে।
মহান সবল মানুষের ঘরটা চমৎকার। পাহাড়ের একেবারে উপরে একটা গুহায়। সেখানে
কোন রোদ বৃষ্টির উৎপাত নেই। আমাদের পৃথিবীর সকল মানুষ এখন সেখানে। তালের রস
দিয়ে বানানো বিশেষ পানীয় নারিকেলের খোলের পারে করে সবাইকে দেয়া হচ্ছে। এ
পানীয় সূর্য দেবতার আশীর্বাদ। মহান সবল মানুষ বলেন যে, সবল মানুষ মারা গেলে
এমন পানীয়, অনেক অনেক দুর্বল মানুষ আর রসালো কচ্ছপ সূর্য দেবতা আমাদের হাত
খুলে দান করবেন যদি আমরা সবল মানুষের কথা মতো চলি। সবল মানুষদের কথা মেনে
চলা দুর্বল মানুষেরাও মারা গেলে সবল মানুষ হয়ে যাবে আর অবাধ্য সবল মানুষদের
দুর্বল মানুষ বানিয়ে হাঙ্গরের সামনে ছেড়ে দেয়া হবে। আমরা কেউ তাই সবল
মানুষের অবাধ্য হই না। দুর্বল মানুষেরাও আমাদের সবল মানুষদের প্রানপণ সেবা
করে যাতে মারা যাবার পর আবার সবল মানুষ হয়ে যেতে পারে।
থিরুকে কেন
যেন একটু চিন্তিত দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষন আগে সারা পৃথিবী কেঁপে উঠেছিলো
ভয়ঙ্করভাবে। পৃথিবী এভাবে ভীষণভাবে কেঁপে ওঠা মানে সাংরা কোন কারণে
অসন্তুষ্ট হয়েছেন তাই বোঝায়। সিরিও অনেক সময় সাংরার সাথে একসাথে অসন্তুষ্ট
হন আর প্রবল জলরাশিকে নির্দেশ দেন আমাদের পৃথিবীর উপর আছড়ে পড়তে। তবে সবসময়
এমন হয় তা নয়, অনেক অনেক চক্র পর পর এমন হয় বলে বয়স্কদের থেকে শুনেছি।
থিরু সবাইকে ডেকে বললেন,
-
“সাংরা রেগে গেছেন। তোমরা সবাই চলে যাও। আমাদের সামনে সমুহ বিপদ। তোমরা
সবাই যাতে রক্ষা পাও তার জন্য আমি সাংরা আর সিরির কাছে প্রার্থনা করবো।
তোমরা সাবধানে থেকো।“
আমার চলে যেতে একটূও ইচ্ছা করছিলো না।
থিরুর অধিকারে থাকা দুর্বল মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে কমবয়সী তরুকে দেখতে আমার
খুব ভালো লাগে। আমার মতই বয়স হবে ওর। তিন চক্র সময় আগে ওকে থিরুর অধিকারে
দেয়া হয়েছে। আমাদের পৃথিবীতে দুর্বল মানুষদের যখন বিষাক্ত রক্ত পড়া শুরু হয়
তখন তাদের মহান সবল পুরুষদের কাছে পৌছে দেয়া হয়। অন্য কোন দুর্বল মানুষের
যখন আবার রক্তপাত শুরু হবে প্রথমবার তখন তরুকে অন্য সবল পুরুষদের জন্য ছেড়ে
দেয়া হবে। থিরু তখন তরুকে মুক্ত করে দিয়ে সেই দুর্বল মানুষের অধিকার
নেবেন। আমি সেই সময়ের জন্য অপেক্ষা করছি। আরো বড় হলে আর আরেকটু শক্তি হলেই
তরুকে নিজের অধিকারে পাবার জন্য আমি জীবন দিয়ে লড়বো। ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে
খুব ভালোলাগে আমার। রাতের আকাশে সাংরার ঘুমিয়ে থাকবার সময়ের উজ্জ্বল
প্রহরীদের দিকে তাকিয়ে থাকতেও আমার এতো ভালোলাগে না। ওর কথা ভাবতেই আমার
যেন কেমন লাগে, শরীরে কেমন যেন এক শিহরণ অনুভব করি। আমি তরুর কথা কল্পনা
করি আর ভাবি যে, কেবল ওর চাহনি আর মুখের কথা মনে করেই এমন অনুভুতি হয়, ওকে
জড়িয়ে ধরতে পারলে কেমন লাগতে পারে?
আমি মাঝে মাঝে লুকিয়ে থিরুর
গুহায় যাই। অনেকবার দেখেছি থিরু তরুর উপর উঠে ওকে শাস্তি দেয় আর আনন্দের
ভঙ্গী করে। অন্য সবল মানুষদের কাছে থেকে শুনেছি দুর্বল মানুষদের এমনভাবে
শাস্তি দেয়ার চেয়ে আনন্দের কাজ নাকি তাদের পৃথিবীতে আর কিছুই নেই। অনেকদিন
দুর্বল মানুষ হিসেবে থাকবার পর তাদের শাস্তির পরিমাণ কমিয়ে দেন সাংরা।
তারা এরপর থেকে শাস্তিগুলো আনন্দের সাথে মেনে নেয় আর মৃত্যুর পর আবার সবল
মানুষ হবার স্বপ্ন দেখে। তার ইচ্ছামত অন্য দুর্বল মানুষদেরও থিরু শাস্তি
দেয়, তবে তারা তরুর মতো গুঙিয়ে কাঁদে না। আমার ওর জন্য মায়া হয়। কি এমন
অপরাধ করেছিলো তরু যে ওকে দুর্বল মানুষ হবার শাস্তি পেতে হয়েছিলো? আমার মন
খারাপ হয় তরুর জন্য। সাংরার অভিশাপে দুর্বল মানুষ হয়ে জন্মানো তরুর জন্য
মায়া হয়, ভীষণ মায়া। আমি বুঝতে চেষ্টা করি এই মায়ার উৎস ঠিক কোথায়? সাংরা
আমাদের ভীষণ অদ্ভুত করে বানিয়েছেন।
থিরুর আশংকাই সত্যি হলো।
সন্ধ্যের আগে দিয়েই আকাশের সমান উঁচু ঢেউ দেখতে পেলাম আমরা বহুদূর থেকেই।
সাগরমাতা সিরি নিশ্চয়ই ভীষণ রেগে গেছেন। আমাদের ধ্বংস করে দিতে জলরাশিকে
নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা বুঝতে পারছিলাম না কি করবো। কেউ কেউ থিরুর গুহার
দিকে দৌড়ে যাওয়া শুরু করলো, তাদের আশা অত উঁচুতে সিরির অভিশাপ পৌঁছাবে না।
হাতে সময় খুব কম। ওরা কি পৌঁছাবে পারবে ওখানে?
আমি বড় একটা
গাছের কোটরে আশ্রয় নিলাম। কোন একটা অবলম্বন দরকার আমার। না হলে ভেসে চলে
যাবো সাগরমাতার বুকে। কিছু বুঝে উঠার আগেই সাগরমাতার পাঠানো জলরাশি আমাদের
উপর আছড়ে পড়লো। আর আক্রোশ থেকে বাঁচবার মতো কোন উপায় আমাদের জানা ছিলো না।
শেষবারের মত আমি প্রিয় কোনকিছু মনে করতে চাইলাম। আমার মনে ভেসে উঠলো তরুর মুখ। এরপর আমার আর কিছুই মনে নেই।
৩ ধীরে
ধীরে আমি আবার জেগে উঠলাম। আবছা চোখে কিছু দেখতে পেলাম যেন। চোখ পুরোপুরি
খুলতেই মাথার উপর সূর্য দেবতাকে দেখতে পেলাম, আর আসপাশে তাকিয়ে দেখলাম
যতদূর চোখ যায় সাগরমাতার অনন্ত জলসীমা। কিন্তু আমি কোথায় এখন? একটু বোধ
ফিরে আসতেই বুঝতে পারলাম, যে বিশাল মৃত বৃক্ষের কোটরে আমি আশ্রয় নিয়েছিলাম
আমি সেই বৃক্ষের কোটরেই আছি। সেই বৃক্ষ আমাকে সহই সাগরমাতার বুকে ভাসছে।
আমাদের
পৃথিবী নিশ্চয়ই ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি বুঝতে পারছিলাম না আমি এখন কি করবো।
ধীরে ধীরে নিশ্চয়ই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবো আমি। আমার বয়স কম। কখনো থিরুর
অবাধ্য হইনি। পৃথিবীর সকল নিয়ম মেনে চলেছি। আবার আমাকে পৃথিবীতে ফেরত
পাঠালে নিশ্চয়ই সবল মানুষ হিসেবেই ফেরত পাঠাবেন সাংরা। তবে মৃত্যুর কথা
ভাবতেও ভীষণ ভয়ের অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হলাম। মৃত্যুকে আমি ভীষণ ভয় পাই!
এভাবে
কয়দিন কেটে গেছে আমি জানি না। ধীরে ধীরে ভীষন দুর্বল হতে থাকি। আঙুল
নাড়াবার শক্তি পর্যন্ত ছিলো না। তবে গাছের সাথে কোন কিছু এসে ধাক্কা লাগবার
শব্দে চোখ খুলে চেয়ে দেখি গাছের ফাঁপা চোঙার মত যানে ভেসে এসে কিছু
অভিশপ্ত সাদা ফ্যাকাশে চামড়ার মানুষ আমার কাছে এসেছে। ওরা অদ্ভুতভাবে আমাকে
ডাকতে থাকে। আমি সেসব কিছুই বুঝতে পারি না। আমি কেবল ভাবতে থাকি, আমি কি
এমন অপরাধ করেছিলাম যে সাংরা আমাকে অভিশপ্ত মানুষদের হাতে তুলে দিচ্ছে?
আমি হতাশায় আবার চোখ বন্ধ করে দেই, মৃত্যু কামনা করতে থাকি!
৪যখন
আমার আবার জ্ঞান ফিরে এলো তখন দেখলাম যে আমি কোন একটা ঘরের ভিতর শুয়ে আছি।
খুবই নরম বিছানায় শোয়া ছিলাম আমি। আরামে আমার চোখে আবার ঘুম নেমে আসছিলো।
তবে আমি চারদিকে চেয়ে অবাক হই। আমার মনে পড়লো অভিশপ্ত মানুষদের কথা। এতো
বিশাল গাছ কোত্থেকে পেলো অভিশপ্ত মানুষেরা যে তার ভেতর এমন করে বাড়ি
বানিয়েছে? অভিশপ্ত মানুষদের ক্ষমতার কথা ভেবে আমি ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম।
হঠাৎ
দেখলাম আমার চেয়ে অনেক লম্বা আর শক্তিশালী এক অভিশপ্ত দুর্বল মানুষ প্রবেশ
করলো ঘরে। আমাকে দেখেই অদ্ভুত ভাষায় কি বলে যেন চিৎকার করে উঠলো। সে শব্দ
শুনে আরো অনেক অভিশপ্ত মানুষ ছুটে এলো। আমি আবারো ভয় পেলাম। থিরু বলতো
অভিশপ্ত মানুষেরা নাকি লোভ দেখিয়ে আমাদের ধরে নিয়ে খেয়ে ফেলে। ওরাও কি
আমাকে তবে খেয়েই ফেলবে? আমি শোয়া থেকে উঠে পালাবার চেষ্টা করি। লড়াই করবার
জন্য আমার বর্শা কিংবা একটা লাঠি হলেও খুব দরকার। লড়াই না করে হেরে যাবার
শিক্ষা আমার পৃথিবীর মানুষেরা আমাকে দেয়নি। আমি ঘরের এক কোণে সরে যাই, একটা
কাঠের টুকরো মত পেয়ে সেটা জোরে জোরে নাড়িয়ে তাদের সাবধান করে দেই কাছে না
আসতে। হঠাৎ করে বাইরে চোখ যেতেই আমি অবাক হয়ে যাই। চারদিকে সাগরমাতার
জলরাশি। তবে আমি কোথায় আছি? ওরা কি বড় কোন গাছের ভেতরেই নিজেদের পৃথিবী
তৈরী করে নিয়েছে? যেই গাছকে ওরা ভেসে থাকবার মত করে বদলে নিয়েছে?
আমার
হাতের কাঠ দেখে কেউ ভয় পেয়েছে বলে মনে হলো না। বরং হাত দিয়ে কেউ কেউ কেমন
যেন ইশারা করছিলো। ওরা নিশ্চয়ই আমাকে লোভ দেখাতে শুরু করবে, এরপর ধরে খেয়ে
ফেলবে। আমি আবার ভাবলাম, না, এটা কেমন করে হয়? আমিতো প্রায় মারাই
যাচ্ছিলাম। তখনই তো ধরে আমাকে খেয়ে ফেলতে পারতো। তবে কি এরা আমাকে মারবে
না? এদের উদ্দেশ্য তবে ঠিক কি?
এর মধ্যেই পেছন থেকে কে যেন জোরে
আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমি নিজেকে মুক্ত করতে পারি না। তবে প্রথমবার দেখা
অভিশপ্ত দুর্বল মানুষতা আমার সামনে গিয়ে আসে। আমার মাথার কোঁকড়া চুলে আলতো
করে হাত রাখে এবং ধীরে ধীরে হাত বুলাতে থাকে। এমন করে আমার মা আমার মাথায়
হাত বুলাতো। আমার খুব মন খারাপ হয়ে যায় হুট করে। আমার মা কি বেঁচে আছে নাকি
সাংরার অভিশাপে মারা গেছে?
আমার সামনে দাঁড়ানো অভিশাপ দুর্বল
মানুষটিকে আমার মায়ের মত মনে হতে থাকে। আমার হঠাৎ করেই ভীষণ কান্না পেলো।
আমি চিৎকার করে কান্না শুরু করলাম। আমাকে ধরে রাখা সবল মানুষটা এ সময়
আমাকে ছেড়ে দিলো। আমি অভিশপ্ত দুর্বল মানুষটার কাছেই ছুটে গেলাম। তাকে
জড়িয়ে ধরে তার শরীরে মুখ লুকাতে চাইলাম। কই, এই অভিশপ্ত দুর্বল মানুষটাতো
আমার কোন ক্ষতি করছে না! বরং আমার মায়ের কাছে থাকলে যেমন ভরসা পেতাম তেমন
মনে হচ্ছে! আমি তার চোখের দিকে চেয়ে দেখলাম, কুৎসিত রঙয়ের চামড়া, তবে তার
চোখে আমি মমতা দেখতে পেলাম। আমার মায়ের মতই মমতা মাখা সে দুটো চোখ। থিরু আর
আমাদের পৃথিবীর মানুষেরা কি তবে ভুল বলতো কিংবা ভুল জানতো?
৫অনেকদিন
আমি অভিশপ্ত মানুষদের ভাসমান পৃথিবীতে ছিলাম। আমি তখনো জানতাম না যে ওদের
পৃথিবীটা আমাদের চেয়ে অনেক অনেক বড়। এতো বড় যে আমাদের পৃথিবীর কেউ কল্পনাও
করতে পারবে না। আমাকে এতদিন সেই দুর্বল মানুষ আর সাথের মানুষেরা অনেক
যত্নেই রেখেছিলো। কেউ আমার কোন ক্ষতি করেনি। ওদের খাবারগুলো অন্যরকম।
একেকটার স্বাদ একেক রকম। সবই ভীষন মজার। ওরা খাবারগুলো আগুন দিয়ে কীভাবে
যেন গরম করে ফেলে আর তার সাথে অনেক কিছু মিশিয়ে তৈরী করে। থিরু বলতো আগুন
সাংরার অভিশাপ। আমরা মাঝে মাঝেই বৃষ্টির সময় আকাশ থেকে আগুন কিংবা সাংরার
অভিশাপ নেমে আসতে দেখতাম। অনেক সময় অনেক পাখি কিংবা প্রাণী মারা যেতো সেই
অভিশাপে। অনেকবার মানুষও মারা গেছে বলে আমি শুনেছি অন্যদের কাছ থেকে।
কিন্তু এই অভিশপ্ত মানুষেরা এই আগুন নিয়ে খেলা করে। ওরা সাংরার অভিশাপকে বশ
করে ফেলেছে বলে মনে হয়। ওরা কি তবে সাংরার থেকেও ক্ষমতাশালী?
বেশ
কিছুদিন পর এই ভাসমান পৃথিবী অভিশপ্ত মানুষদের আসল পৃথিবীতে পৌঁছালো।
আশেপাশে আরো অনেক ভাসমান পৃথিবী দেখতে পাই, ওগুলোকে চলতে দেখি। আমি
প্রথমবারের মত বুঝতে পারি এগুলো কোন পৃথিবী নয়, বরং অভিশপ্ত মানুষরা এর
মাধ্যমে সাগরমাতার বুকে ভেসে বেড়ায়। তবে একটু পরেই আমার সেই ভুলও ভেঙে গেলো
যখন দেখলাম অভিশপ্ত মানুষদের পৃথিবীকে দুইভাগে ভাগ করে দিয়েছে সাগরমাতার
ঘোলা পানির একটা সরু অংশ। সেখান দিয়েও ভেসে বেড়াতে পারে এই জিনিসটা।
অভিশপ্ত মানুষদের পৃথিবী মনে হচ্ছে দুইটা। সাগরমাতা কি তাদের কোন অপরাধের
জন্য শাস্তি হিসেবে তাদের পৃথিবীকে আলাদা করে দিয়েছেন?
আমি আর
কিছুক্ষণ পর আরও অবাক হলাম। অভিশপ্ত মানুষদের আসলে অনেক পৃথিবী। আমাদের
পৃথিবীর চেয়ে অনেক অনেক বড়। আর সবাই কি হাসিখুশী ভাবে পৃথিবীর প্রান্তে
সাগরমাতার সরু অংশের পাশে এসে নানা কাজ করছে। অভিশপ্ত হলে এরা কীভাবে এতো
নিশ্চিন্তভাবে ঘুরছে, হাসতে পারছে এসব ভেবে আমার অবাক লাগছিলো। আমি বুঝতে
পারছিলাম এতদিন থিরু আর অন্যরা যা বলে এসেছে সেসব হয়তো সত্য নয়। আর অভিশপ্ত
মানুষদের ফ্যাকাশে সাদা চামড়ার চেহারা দেখতেও এখন আমার খারাপ লাগছে না।
আমি নিজের চামড়ার সাথে ওদের চামড়া মেলালাম। আমি কখনো আমার মুখ দেখিনি পানির
উপর আবছা ছায়ার মতো ছাড়া। তবে ভাসমান পৃথিবীতে একটা চকচকে বস্তুতে নিজেকে
প্রথম দেখতে পাই। প্রথম প্রথম ভয় পেয়েছিলাম, তবে একটু পরে বুঝতে পারি সে
জিনিসটার সামনে থাকা যেকোন জিনিস হুবহু দেখাবার ক্ষমতা আছে। অভিশপ্ত
মানুষেরা নিশ্চয়ই এটা বানিয়েছে কিংবা কেউ তাদের এটা দিয়েছে। যে তাদের এটা
দিয়েছে সে নিশ্চয়ই অনেক ক্ষমতাবান। সেই কি এই মানুষদের দেবতা? তার শক্তি কি
সাংরার চেয়েও অনেক বেশি? তাই তো মনে হচ্ছে।
আমি সেই চকচকে বস্তুতে
নিজেকে দেখে এই মানুষদের সাথে নিজের পার্থক্য বুঝতে চেষ্টা করি। ওদের
চামড়া ফ্যাকাশে, উচ্চতা একটু বেশি, চুলগুলো একটু সোজা আর লম্বা। আমার মত
কোঁকড়া নয়। এর বাইরে খারাপ কিছু দেখিনি আমি। কেউ আমার সাথে আক্রমণের কোন
ভঙ্গী করেনি, বরং ওদের ভাবভাবে মায়ার ভঙ্গী পেয়েছি। ঠিক যেমনটা আমার মা আর
আমার শেষ বাবা আমার সাথে করতো। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে ওরা খারাপ কেউ হতে
পারে না। আমিতো মারাই যাচ্ছিলাম। ওরাই তো আমাকে বাঁচিয়ে তুলেছে। ওরা কেন
খারাপ হবে?
৬বেশ অনেকটা সময় চলে গেছে আমি
নতুন পৃথিবীতে এসেছি। আমি এখন একজন বড় সবল মানুষ, বড় দুর্বল মানুষ আর তাদের
সন্তান এক ছোট দুর্বল মানুষের সাথে থাকি। ওদের অনেক কথা বুঝতে পারি, কিছু
কিছু বলে বোঝাতেও পারি। এই পৃথিবীর নিয়ম আলাদা। এখানে মনে হয় দুর্বল
মানুষদের অন্যভাবে দেখা হয়। আমার এই ঘরের সবল মানুষটা এই দুর্বল মানুষটাকে
মনে হয় ভয়ও পায়। এই সবল মানুষটা আমাকে তেমন যত্ন করে না, কিন্তু দুর্বল
মানুষটা খুব যত্ন করে। আমাকে এসে খাওয়ায়, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আমার খুব
ভালো লাগে। এখানে আমাকে শিকারে যেতে হয়না। এই পৃথিবীতে একটা জায়গা আছে
যেখানে সব খাবার আর নানা অদ্ভুত জিনিস পাওয়া যায়। ওরা এক ধরনের পাতলা
চামড়ার মত জিনিস দিয়ে সেগুলো নিয়ে আসে। আমি জানি এই পাতলা চামড়াগুলো অনেক
মূল্যবান। প্রতিদিন নতুন কিছু দেখি, এদের যতই দেখছি ততই অবাক হচ্ছি। কোথাও
কোন অভিশাপের চিহ্ন দেখি না। এরা কি তবে অভিশপ্ত কেউ নয়?
আমি মনে
মনে ঠিক করে ফেলেছি এদের আর অভিশপ্ত ভাববো না। এরা আমাকে ভালোবাসে। যারা
আমাকে বাঁচিয়েছে আর আমাকে এতো ভালোবাসে আমি তাদের অভিশপ্ত ভাবতে পারি না।
আমি এদের মানুষ বলেই ডাকবো এখন থেকে। আমি বুঝে গেছি এরা ভালো কেউই হবে।
আমরাই মনে হয় অভিশপ্ত ছিলাম। আমাদের জীবন অনেক কষ্টের ছিলো। থিরু আমাদের
ভুল বুঝিয়েছিলো। থিরু তরুকেও ওইভাবে কষ্ট দিতো। থিরু নিশ্চয়ই খারাপ মানুষ
ছিলো। এখানে তো আমার নতুন মাকে কিংবা এই তরুর বয়সী দুর্বল মানুষটাকে কেউ
কষ্ট দেয় না। বরং অনেক আদর করে। আমি এই ঘরের দুর্বল মানুষটাকে মনে মনে
আমার মা বলে ভাবা শুরু করেছি। এই ছোট দুর্বল মানুষটাকে কি বলবো আমি জানি
না। ওকে দেখলেও আমার খুব আদর করতে ইচ্ছা করে। ওর সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করে
অনেক। চেষ্টাও করি অনেক, তবে এখনো সবকিছু বুঝতে পারি না। তবে আমি ওদের
সবাইকে অনেক পছন্দ করছি এটা জানি। ওরা অভিশপ্ত নাকি অভিশপ্ত না এটা এখন
আমার মনেই আসে না।
এখানের জীবনটা একটু অদ্ভুত। আমরা সূর্য দেবতা
ঘুমাতে গেলে সাথে সাথে সকল কাজ বন্ধ করে দিতাম। সূর্য দেবতা জাগলে আমরাও
জাগতাম। তবে এখানে সূর্য দেবতা ঘুমাতে যাবার পরেও বশ করে নেয়া আগুনের আলোয়
ওরা সব কাজ করে। আমি প্রথম প্রথম ভয় পেতাম আগুনকে। এখন বুঝে গেছি আগুনকে ভয়
পাবার কিছু নেই। আগুনকে বশ করতে পেরেছে বলেই রাতেও ওদের জীবন থেমে থাকে
না।
এরা আমাকে অদ্ভুতভাবে ইশারা করে ‘বাবু’, ‘বাবু” বলে শব্দ
করতো। কিছুদিন পর আমি বুঝে যাই ওরা আমাকে ‘বাবু’ নামে ডাকছে। ওরা আমার এই
নাম দিয়েছে। আমি নিজের দিকে ইশারা করি আর বলি, ‘নিবু’, ‘নিবু’। ওরা বুঝতে
পারে হয়তো আমি আমার নাম জানাতে চাই। ওরা বলে ‘নীলু’, ‘নীলু’। বুঝলাম ওদের
‘নিবু’ পছন্দ হয়নি দেখে ‘নীলু’ ডাকছে। আবার বেশ ভালোই লাগলো। এরপর ওরা ছোট
দুর্বল মানুষটার দিকে ইশারা করে বলে, ‘ইরা’, ‘ইরা’। আমি বুঝতে পারি ওরা
আমার নাম ‘নীলু’ আর ওই ছোট দুর্বল মানুষটার নাম ইরা’ বলছে। বড় দুর্বল
মানুষটা নিজের দিকে ইশারা করে বলে, ‘মা’, ‘মা’। আমি উচ্চারণ করি, ‘মা’। এ
কথা বলার সাথে সাথেই বড় দুর্বল মানুষটি আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমি বুঝতে পারি বড়
দুর্বল মানুষটা খুব খুশী হয়েছে আমি তাকে ‘মা’ বলে ডাকায়। এভাবে বড় দুর্বল
মানুষটাকেও যে ‘বাবা’ বলে ডাকতে হবে তাও বুঝে যাই। আমি এখন থেকে ওদের এই
নামেই ডাকবো।
একদিন ‘মা’ আমার সামনে অনেকগুলো পাতলা চামড়ার মত একটা
জিনিস এনে রাখলো। এরপর সেটা সামনে রাখলে ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’ এমন অনেকগুলা চিহ্ন
দেখতে পাই। উনি সেগুলো একে একে দেখিয়ে উচ্চারন করেন, ‘ক’, ‘খ, ‘গ’। আমাকেও
ইশারায় তেমন করে বলতে বলেন। আমিও চেষ্টা করি সেগুলো বলতে। ইরা আমার সাথে
সব সময় এই পাতলা চামড়ার মত জিনিসগুলো নিয়ে থাকতো আর চিহ্নগুলো শেখাতে
চাইতো। এখানে শিকার করতে হয় না, কোন কাজ করতে হয় না। এগুলো শেখা ছাড়া আমার
কোন কাজও নেই। আর এগুলো জেনে গেলে আমি মনে হয় ওদের কথা বুঝতে পারবো। ওদের
সব কথা জানতে পারবো। তাই আমি প্রানপন চেষ্টা করতে থাকি এগুলো শিখতে।
কিছুদিনের
মধ্যে আমি ‘আসো’, ‘যাও’, ‘তুমি’, ‘আমি’, ‘এটা’, ‘ওটা’, ‘ভাইয়া’, ‘আপু’,
‘বলো’, ‘শোনো’ এসব অনেক কথা বলতে শিখে যাই। এসব দিয়ে ওরা কি বোঝায় সেটা আমি
এখন জানি। এগুলো শিখে যাবার পর ওদের অন্য সবকিছু আমি খুব দ্রুতই বুঝে যেতে
শুরু করেছি।
৭বেশ কয়েক চক্র পেরিয়ে গেছে।
আমি এখন জানি যে আমরা যেটা চক্র ভাবতাম তেমন কিছুকেই বাংলায় বলে বছর। এরা
একদম নির্ভুলভাবে বছর কিংবা দিনের হিসাব জানে। আমিও এখন বাংলায় কথা বলতে
জানি। আরো অনেক কিছুই শিখছি, অনেক কিছুই জানছি। আমি এখন জানি যে পৃথিবীটা
আসলেই অনেক বড়। আর পৃথিবী আলাদা আলাদা নয়। সব জায়গা নিয়েই পৃথিবী আর একেক
জায়গায় একেক রকম মানুষ থাকে। কেউ আমার মত দেখতে হয় আবার কেউ বাবার মত। আবার
কেউ আরো অন্য রকম। বাংলার মত আরো অনেক ভাষাও আছে। একেক জায়গার মানুষ একেক
ভাষায় কথা বলে। আবার অনেক গুলো জায়গা নিয়ে একটা দেশ হয়। পৃথিবীতে এমন অনেক
অনেক দেশ আছে। আমাদের দেশটার নাম বাংলাদেশ। আমরা আছি চট্টগ্রাম নামের একটা
বন্দর শহরে। ভাসমান পৃথিবীর নাম আসলে জাহাজ। ছোট জাহাজকে নৌকা বলে। এ শহরে
অনেক অনেক জাহাজ আসে। যেখানে অনেক জাহাজ আসে সেটাকে বন্দর বলে। চট্টগ্রাম
তাই বন্দর শহর। শহর হচ্ছে এমন একটা জায়গা যেখানে বেশি জ্ঞানসম্পন্ন আর
পরিশ্রমী মানুষেরা থাকে। গ্রামেও থাকে, তবে কম করে। ওখানে বেশির ভাগ মানুষ
খাদ্য উৎপাদনের কাজ করে। একে বাংলায় বলে কৃষিকাজ। আমার আগের পৃথিবীতে
কৃষিকাজ ছিল না।
ইরার সাথে আমার অনেক ভালো সম্পর্ক হয়েছে। ও
আমাকে ভাইয়া ডাকে। মানে আমি ওর ভাই আর ও আমার বোন। আমি বাবা মা এসবের মানেও
এখন জানি। এই পৃথিবীটা আসলে অনেক সুন্দর। তবু আমার মাঝে মাঝে আমার আগের
পৃথিবীর জন্য খুব মন খারাপ হয়। তরুর কথা ভেবে মন খারাপ হয়। আগের পৃথিবীর
মায়ের কথা ভেবে মন খারাপ হয়। আমি নিশ্চয়ই একদিন আমার আগের পৃথিবীকে খুঁজে
বের করবো। তাদের এই পৃথিবীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো। ওদের বোঝাব যে অভিশপ্ত
পৃথিবী বলে আসলে কিছু নেই। থিরু আর অন্য অনেকে আমাদের ভুল বুঝিয়েছিলো।
আমি
এখন এদের সব খাবার খেতে পারি। খাবার ঠান্ডা কিংবা গরমও হয় এটা জানি। নানা
স্বাদের খাবার হয়। এরা কচ্ছপ খায় না। তবে গরু, ছাগল এমন নামের কিছু প্রানীর
মাংস অনেক বেশি খায়। আরও অনেক কিছুই খায় এরা। এখানে খাবার অনেক প্রকারের
হয়, সবগুলো আমি এখনো জানি না। তবে ওরা আগুন দিয়ে খাবারকে অন্যরকম করে ফেলে।
একে বলে রান্না করা। রান্না করলে মাংসের স্বাদ অন্যরকম হয়ে যায়। খুবই
মজাদার হয় খেতে। আমি প্রথমে ঝালের জন্য খেতে পারতাম না। এখন সবই খেতে পারি।
আমি পছন্দ করি ভর্তা খেতে। নানা শাকসব্জি কিংবা মাছ দিয়েও ওরা ভর্তা করে।
আমাকে এখন কচ্ছপ আর ভর্তার মধ্যে যে কোন একটা খেতে বললে আমি ভর্তাই খাব।
অল্প কয় বছরেই এতটা বদলে গেছি আমি। আমার এই পরিচয়টার নাম বাঙালি। আমি একদিন
জিজ্ঞেস করেছিলাম,
- “মা, আমি কি বাঙালি?”
মা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো,
- “তুই কি বাংলায় কথা বলিস?” আমি বলেছিলাম,
- “হ্যা।“ মা আবার বলেন,
- "তোর মায়ের ভাষা কি?" আমি বলি,
- “বাংলা।“ মা আবার জিজ্ঞেস করেন,
- “তুই কি আমাদের মত মাছ ভাত ভর্তা পছন্দ করিস না?” আমি বললাম,
- “এসব তো আমার সবচেয়ে পছন্দের।“ মা তখন বলেন,
- “তাহলে তুই বাঙালি না তো কে বাঙালি বল তো আমাকে?” আমি তখন গর্বিত কন্ঠে বলি,
- “কেউ না!“ আমার
মনে হয় বাঙালি হয়েই ভালো হয়েছে। আমাদের ভাষা, চেহারা, আবহাওয়া সবকিছুই
অদ্ভুত। আমি ইদানিং ইংরেজি নামের একটা ভাষাও শিখছি। ইংরেজি ভাষা শেখা আরও
সোজা। একটা কথা সাধারণত একভাবেই বলে সবাই। এদিক সেদিক করলে অন্য মানে হয়ে
যায়। কিন্তু বাংলা অদ্ভুত একটা ভাষা। এখানে একটা কথাই অনেকভাবে বলা যায়।
“আমি মাকে অনেক ভালোবাসি। “ এ কথাটাই অনেকভাবে বলা যাবে। যেমনঃ
“আমি মাকে অনেক ভালোবাসি।“
“মাকে অনেক ভালোবাসি আমি।“
“অনেক ভালোবাসি মাকে আমি।“
“আমি অনেক ভালোবাসি মাকে।“
“মাকে ভালোবাসি আমি অনেক।“
“অনেক ভালোবাসি আমি মাকে।“ এমনভাবে
অনেকরকম করেই বলা যায়, সবগুলোই সঠিক। আমি এখনো এ অদ্ভুত ব্যাপারগুলো
শিখছি, জানছি। পড়ে শেখার চেয়ে শুনে শুনে আর ইরার সাথে কথা বলতে বলতে বেশি
শিখছি।
আবার বাঙালিদের একেকজনের চেহারা একেকরকম। কেউ অনেক সাদা।
কেউ আমার কাছাকাছি কালো। কেউ সাদাও না কালোও না, এদের বলা হয় শ্যামলা। তবে
কেউ বেশি সাদা হলে মনে হয় ওরা একটু বেশি সুন্দর মনে করে। আমার অবশ্য কালোই
এখনো বেশি ভালো লাগে। এখানে অনেক ঋতুও আছে। মা বলেছেন আমাদের দেশের মত ঋতু
অন্য কোথাও নেই। আমাদের এখানে ছয়টি ঋতু। আমি এখন জানি সংখ্যা কি, আঙুল বার
বার দেখিয়ে বোঝাতে হয় না।
আমি এখন বাংলাকে ভালোবাসি। আমার ধারণা
আমি বাঙালিই হয়ে গেছি। মা ইরাকে নিয়ে মাঝে মাঝে একটা গান গায়। গানটা শুনলে
আমার বুকটা কেমন যেন ভারী হয়ে উঠে। গানটা হচ্ছেঃ
“ধন ধান্য পুষ্পে ভরা, আমাদেরই বসুন্ধরা,
তাহার মাঝে আছে দেশ এক, সকল দেশের সেরা...” আমি
আমার এই নতুন পৃথিবীর নতুন দেশকে অনেক ভালোবাসি। কারণ আমার মা বলেন দেশই
নাকি প্রকৃত মা। দেশের জন্য মনে অনেক মায়া রাখতে হয়। দেশকে প্রাণ দিয়ে
ভালোবাসতে হয়। দেশের জন্য যেকোন কিছু করতে প্রস্তুত থাকতে হয়। আমার মা কখনো
মিথ্যা বলেন না। আমি মাকে যেমন ভালোবাসি, নতুন দেশকেও তেমন ভালোবাসি।
দেশের জন্য আমিও সবকিছু করতে পারি। মা আমাকে একটা কথা অনেকবার বলেছেন।
“মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর।“ উনি
আমাকে শিখিয়েছেন ভালোর উপর মন্দের আধিপত্য অল্প সময়ের হয়। মনের অসুরকে সব
সময় দমিয়ে রাখতে হয়। তাহলেই নাকি ভালো মানুষ হওয়া যায়। চরম প্রতিকূল
পরিবেশেও যেন আমরা ভালোমন্দের পার্থক্য ভুলে না যাই। মা বলেন যে, মন্দ
জেনেও যদি আমরা কোন কাজ করি তাহলে মা ভাববেন উনি আমাদের ঠিকমত শিক্ষা দিতে
পারেননি। আমি মায়ের শিক্ষার বাইরে কখনোই যেতে পারবো না। সে ক্ষমতা আমার
কখনো যেন না হয়।
আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু কিংবা সাথী হচ্ছে আমার
বোন ইরা। ও অনেক গল্প করতে জানে। আমি ওর কথাগুলো অবাক হয়ে শুনি। ওর কাছ
থেকে আমি গল্পের বই পড়া শিখি। আমরা একসাথে গান শুনি। ও খুব সুন্দর রবীন্দ্র
সঙ্গীত গায়। হয়তো ইরা রবীন্দ্র সঙ্গীত গায় দেখেই আমার কাছে সঙ্গীতের মধ্যে
সবচেয়ে প্রিয় হচ্ছে রবীন্দ্র সঙ্গীত। প্রিয় মানুষদের সবকিছুই প্রিয় হয়ে
ওঠে। আমি জানি না কি করে এই মানুষগুলো আমার এতো আপন হয়ে গেলো? আমি হয়তো
চাইলেও এখন আগের জীবনে ফিরে যেতে পারবো না। তবে আমার মাঝে মাঝে আগের মা আর
তরুর কথাও মনে হয়। তরুও নিশ্চয়ই ইরার মত বড় হয়ে গেছে যদি বেঁচে থাকে। শাড়ি
পরলে ওকে ঠিক কেমন লাগতো? ও কি সত্যি বেঁচে আছে?
৮অনেক
বছর হয়ে গেছে আমি চট্টগ্রামে আছি। আমি এখন পুরোপুরি অন্য এক মানুষ। দেখতে
একটু অন্যরকম হলেও কথাবার্তা, চালচলন এবং অন্য সবকিছুতে আমি আশেপাশের
মানুষগুলোর মতই। আমি আসলে হয়েছি আমার মায়ের মত। আগের মাকে আমার খুব একটা
মনে পড়ে না। তবে এই যে নতুন আমি, এর পুরোটাই গড়ে দিয়েছেন আমার মা, আমার
নতুন পরিবার।
এই নতুন আমার লক্ষ্য অবশ্য বাবার মত নাবিক হওয়া।
সাগর আমাকে টানে। আমি স্বপ্ন দেখি আমার সেই পুরোনো পৃথিবীর খোঁজ পাবো একদিন
না একদিন। মাঝে মাঝে বাবার সাথে আমার কথা হয় আমাকে কোথা থেকে জাহাজে তুলে
নিয়েছিল এ ব্যাপারে। বাবা বলেন জায়গাটা আন্দামান আর মালদ্বীপের মাঝামাঝি
কোথাও হবে। আমি সম্ভবত অনেকদিন ধরে সাগরে ভাসছিলাম।
এরই মধ্যে
আমার বাবার সাথে আমি প্রথমবার যাত্রা করি সাগরে। একটা সময় আমার সুযোগ হয়
আন্দামানের পোর্ট ব্লেয়ারে যাবার। সেখানে আমি আমার মত চেহারার কিছু মানুষ
দেখতে পাই। পুরনো দিনের ভাষায় অস্পস্ট স্বরে ওদের সাথে কথা বলতে চাই। ওরা
বোঝে না আমার কথা। আমি বুঝে যাই এরা আমার আগের পৃথিবীর মানুষ নয়। তবে
নিশ্চিত হই আশেপাশেই কোথাও না কোথাও আমার আগের পৃথিবীর অবস্থান। আমার মন
বলে সে কথা।
মায়ের অনুমতি নিয়ে আমি কিছু সময়ের জন্য বন্দরে চাকরী
নিয়ে থেকে যাই সেখানে। আশেপাশের এলাকা সম্পর্কে পড়াশুনা করি। জানতে পারি
এখানে অনেক দ্বীপ আছে যেখানে এখনো সভ্যতার আলো পৌঁছেনি। আর কেউ সেখানে গেলে
স্থানীয় আদিবাসীরা তাদের সহ্যও করে না। সব জায়গায় যাবার সামর্থ্য, সময় আর
অর্থও আমার নেই। তবে আমি নিজের প্রকৃত পরিচয়ের কাছে ফিরে যাবার তাগিদ থেকে
নিজেকে বিরত রাখতে পারি না। আমি যেমন নতুন এবং পরিপূর্ণ একজন মানুষ হয়ে
উঠেছি, আমি চাই আমার পুরোনো পৃথিবীর মানুষগুলোও তেমন হোক। মাকে দেখতে ইচ্ছে
করে, তরুর কথাও এখনো ভুলতে পারি না। কিশোর হৃদয়ের প্রথম ভালোলাগা আর
মুগ্ধতার বিস্ময় কখনোই মন থেকে মুছে ফেলা যায় না।
৯বেতারের
সংবাদ থেকে জানা গেছে প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড় এগিয়ে আসছে আন্দামানের দিকে। সবাই
সম্পূর্ণ নিরাপদ অবস্থানে সরে গেলাম। আশেপাশের দ্বীপ থেকে অনেক স্থানীয়
মানুষকেই সরিয়ে নিয়ে আসা হলো। এরপর অপেক্ষা করতে লাগলাম আঘাতের। আশ্রয়
কেন্দ্রের ভেতরে থেকে লক্ষ্য করলাম প্রকৃতি কি ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে পারে।
প্রচন্ড বাতাসের সাথে জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেলো সমস্ত দ্বীপপুঞ্জ। মনে
হচ্ছিলো আকাশ থেকে আগুনের হল্কা ছুটে আসছে ঘনঘন বজ্রপাতের সময়। পরদিন সকালে
সবকিছু একটু শান্ত হয়ে আসলে দেখলাম আশেপাশের সবকিছু লন্ডভন্ড। কিছু
নারিকেল গাছ ছাড়া অন্য কোন গাছের একটা পাতাও অবশিষ্ট নেই। সাগরে ভেসে
বেড়াচ্ছিলো লাশ আর লাশ। এখানে সেখানে কেবল লাশ। আমি মনে মনে ভাবছিলাম আমার
আগের পৃথিবী যেন এর আশেপাশে না হয়। তাহলে কাউকে জীবিত দেখবার যে আশাটুকু
বুকে ধারণ করে আছি সেটাও আর থাকবে না।
উদ্ধার অভিযানে বের হলাম
আমরা ভারত সরকারের অনুরোধে, আমাদের ভাগ্যক্রমে প্রায় অক্ষত জাহাজ নিয়ে।
প্রথম গন্তব্য জাওয়ারা আইল্যান্ড। যেখানের অধিবাসীরা সংরক্ষিত এলাকায় থাকে।
সরকারের কড়া নির্দেশ আছে ওদের যেন না ঘাটানো হয়। ওরা বাইরের পৃথিবীর
মানুষদের তেমন পছন্দও করে না, এড়িয়ে চলতে চায়। আর বাইরের পৃথিবীর মানুষের
কাছাকাছি আসলে ওরা নানা রোগেও আক্রান্ত হয় অজানা ভাইরাসের সংক্রমণে। শেষবার
যখন ওদের কাছে ইংরেজদের একটা দল গিয়েছিলো, তার পরপরই মহামারীর মত হাম
ছড়িয়ে পরে। অনেক লোক মারা যায়। ওদের দেহে বাইরের পৃথিবীর নানা ভাইরাস আর
জীবানু থেকে বংশানুক্রমিকভাবে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠেনি। তবে আরো কিছু
দ্বীপের মানুষের মত আক্রমণাত্মক নয় আর সংখ্যায়ও বেশি দেখে ওখানেই আগে আবার
সিদ্ধান্ত হলো উদ্ধার অভিযানে।
সেখানে গিয়েও দেখা গেলো লাশ আর
লাশ। এদের সবাই দেখতে প্রায় আমার মতই। আমাকে দেখে ওদের কেউ কেউ নিজের মানুষ
মনে করে এগিয়েও এলো। তবে আমি তাদের ভাষাও বুঝতে পারলাম না। তাদের জন্য
যথাসম্ভব খাদ্য আর বিশুদ্ধ পানীয় রেখে আমরা অন্য গন্তব্যের দিকে এগিয়ে
গেলাম।
জাহাজের চার্টে অনেকগুলো দ্বীপের নাম দেখলাম, তথ্য মতে
যেখানে মানুষ থাকবার কথা। এরমধ্যে একটা বড় দ্বীপও দেখলাম। জাহাজের
ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞেস করায় উনি বললেন, এখানে কেউ বেঁচে থাকবার সম্ভাবনা নেই।
সেখানে বেশ অনেক বছর আগে এক ভূমিকম্পের পর সুনামী আঘাত হানে। এরপরই যেখানে
উদ্ধারকারী দল যায় সেখানে এবং ম্যাপে দেখানো আসেপাশের আরো কিছু দ্বীপে।
তবে কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। জনমানবশূন্য দ্বীপ হিসেবেই এগুলো চার্টে
চিহ্নিত আছে।
ভূমিকম্প আর সুনামীর কথা শুনে আমার নিজের অভিজ্ঞতার
কথা মনে হলো। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এটা আমার আগের পৃথিবী নয়তো? আমি
জাহাজের ক্যাপ্টেনকে অনুরোধ করলাম এই দ্বীপটার পাশ দিয়ে হলেও যেন যান, তীরে
ভিড়বার দরকার নেই। কোন জীবিত মানুষ থাকলে হয়তো দেখা যাবে। বহু অনুরোধ,
অনুনয়ের পর ক্যাপ্টেন রাজী হলেন।
১০দ্বীপের
কাছাকাছি পৌঁছাবার পরই আমার মন কেমন করে উঠলো। যদিও ঠিক মনে ভেসে ওঠে না
আমার আগের পৃথিবীর কথা, তবে কোথায় যেন একটা মিল খুঁজে পাচ্ছি। দূরে একটা
পাহাড়ের মতও দেখা যাচ্ছে, এখানকার দ্বীপগুলোর বেশিরভাগেই যেমন দেখা যায়।
আগের সাথে মেলাবো সেই উপায়ও তেমন নেই, কারণ কোথাও কোন সবুজ নেই। ঘূর্ণিঝড়ের
তীব্রতায় সব গাছ ন্যাড়া হয়ে গেছে। তবে কোথাও একটা পরিচিত গন্ধ, কোন পরিচিত
অবয়ব মিলে যাচ্ছে। আমি এর আকর্ষন এড়াতে পারলাম না। আমি ক্যাপ্টেনকে বললাম,
আমি এই দ্বীপে নেমে যাব, এখানে জীবিত কেউ থাকুক আর নাই থাকুক। ক্যাপ্টেন
বললেন,
- “পাগল হয়েছো তুমি? এখানে একা একা তুমি কি করবে?”
আমি বললাম,
-
“জানি না! তবে আমার মন বলছে এটাই আমার আগের পৃথিবী। আমার আগের মানুষের
কেউও যদি বেঁচে থাকে, তবে তাদের ফেলে আমি চলে যেতে পারি না। যত সময়ই লাগুক
আমি পুরো দ্বীপ খুঁজে দেখবো।“ ক্যাপ্টেন রেগে জবাব দিলেন,
- “আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করবো না। আমাদের আরো অনেক জায়গা দেখা বাকী আছে। তোমার কথা মানার অর্থ হচ্ছে পাগলামীকে প্রশ্রয় দেয়া।“ আমি বললাম,
- “এই পাগলামীর জন্য আমি যেকোন কিছু করতে পারি। তবু আমি একেবারে নিশ্চিত না হয়ে এখান থেকে যাবো না।“
সবাই
আমাকে বোঝালো এরপর। তবে আমি অনড় রইলাম সিদ্ধান্তে। শেষমেষ কাগজে লিখিত
দিয়ে আমি একটা ছোট নৌকায় কিছু খাবার, পানি আর একটা পিস্তল নিয়ে নেমে
পড়লাম। শুরু হলো আবার যাত্রা, কাকতালীয় কিছু একটা হবার ক্ষীণ এক আশা বুকে
নিয়ে। মানুষ আশা নিয়েই বাঁচে, কখনো আশা হারায় না। আমিও হারাতে চাই না।
১০দ্বীপে
যখন উঠে আসলাম তখন প্রায় বিকেল। বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগের আমার কোন
উপায়ও নেই। তবে ক্যাপ্টেন কথা দিয়ে গেছেন কখনো আবার এদিক দিয়ে গেলে দ্বীপের
কাছ দিয়ে যাবেন। তীরের দিকে লাঠির আগায় পতাকার মত কিছু বেঁধে রাখা আছে
দেখলে বুঝবেন যে আমি বেঁচে আছি আর ফেরত যেতে ইচ্ছুক।
বেশ কয়দিন
কেটে গেলো দ্বীপ চষে বেরিয়ে। তবে জনমানবের কোন লক্ষণ দেখতে পেলাম না। আমরা
যেভাবে দেয়ালবিহীন ঘর তৈরী করে থাকতাম তেমন কোনকিছুর চিহ্নও নেই। থাকলেও
ঘূর্ণিঝড়ের কারণে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
সমতলের প্রায় প্রতিটা
জায়গা দেখা হয়ে গেছে। কেবল মধ্যভাগের উঁচু পাহাড়ের মত জায়গাটা বাকী আছে
দেখবার। খুব চেনা মনে হচ্ছিলো জায়গাটা তবু পাহাড়টার উচ্চতা কম মনে হচ্ছে।
দ্বীপটাকেও কেমন যেন ছোটই মনে হয়েছে। ভুল করেছি মনে হচ্ছে। এটা আমার দ্বীপ
হতে পারে না। তবে ভুল ভাঙলো যখন পুরোনো পৃথিবীর সময়ের চক্র বদলের জায়গাটা
দেখলাম, সেই বড় পাথরটা, পাহাড়ের অপরপ্রান্তে। দ্বীপ, পাহাড় সবকিছুই কীভাবে
ছোট হয়ে গেলো ভাবছিলাম। ভুল ভাঙলো যখন সেই পড়ে থাকা বড় পাথরের উপরে এক
লাফে উঠে গেলাম। আগে হাত দিয়ে উপরের প্রান্ত ধরে বেয়ে উপর উঠতে হতো। বুঝতে
পারলাম, আসলে দ্বীপও ছোট হয়নি, পাহাড়ও না। আমি নিজেই বড় হয়ে গেছি। আগে পুরো
দ্বীপ দেখতাম সাড়ে তিনফুট কিংবা চারফুট উচ্চতা থেকে, এখন দেখি পাঁচফুট সাত
ইঞ্চি উচ্চতা থেকে। সময় মানুষের দৈহিক গড়নের সাথে সাথে মন এবং দেখবার
দৃষ্টিও বদলে দেয়।
এটাই আমার সেই পুরোনো পৃথিবী তা সম্পর্কে
নিশ্চিত হবার পর আমার উৎসাহ আর বেড়ে গেলো। জেদ কিংবা বোকামীর পরিণতি দেখতে
উদগ্রীব ছিলাম আমি। প্রায় মাইলখানেক দৈর্ঘ্য আর প্রস্থ্যের এই দ্বীপের কোন
অংশ আমি খুঁজতে বাকী রাখবো না।
১১প্রথমেই
আমি দ্বীপের কোন অংশে কীভাবে খোঁজ করব সে সম্পর্কে খসড়া পরিকল্পনা সাজিয়ে
নিলাম মনে মনে। ছেলেবেলার ঝাপসা স্মৃতি থেকে আমি জানি আমার আগের পৃথিবীর
কেউ বেঁচে থাকলেও সামনে আসবে না কেউই। অচেনা যে কাউকে আমরা শত্রু বলেই ধরে
নিতাম। যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতাম তাদের। চেহারায় মিল দেখলেও এখন আমার সাথে
তাদের কেউ বেঁচে থাকলে প্রধান পার্থক্য হবে পোষাক। আমি তীরের একটা খাড়া
টিলা ঘেঁষে সাজিয়ে নেয়া আমার আস্তানায় আমার সকল পোষাক খুলে রাখলাম। সেই
পুরোনো দিনের মত দক্ষ হাতে নারিকেল পাতা বুনে বানিয়ে নিলাম নেংটির মত আদিম
অকৃত্রিম পোষাক। কেউ যদি বেঁচে থাকে তবে আমার এই রূপ দেখে এগিয়ে আসলে
আসতেও পারে।
পরিকল্পনা মোতাবেক সন্ধান অভিযানে বেশ কিছুদিন গেলো,
কোনকিছুর চিহ্নই পেলাম না। তবে একটা প্রায় উপড়ে যাওয়া কাঁটাবহুল গাছের
ঝোপের মাঝে একটা বড় সামুদ্রিক কচ্ছপের খোলস আটকে থাকতে দেখে ছুটে গেলাম।
ভেতর থেকে অনেক কষ্টে বের করে এনে পরীক্ষা করলাম খোলসটা। আমাদের পৃথিবীতে
আগুন কিংবা লোহার ব্যবহার ছিল না। তবে কচ্ছপের খোলসের সাথে লেগে থাকা
চামড়ার মত শক্ত চর্বির স্তরটা সবারই খুব প্রিয় খাদ্য ছিলো। এগুলো পাথর দিয়ে
ঘষে ঘষে চেঁছে তোলা হতো। পরে ব্যবহারের জন্য খোলসে সাধারণত বৃষ্টির
পানি কিংবা তালের রস দিয়ে বানানো মদ রাখা হতো। আমি খোলসের ভেতরের অংশে
আঁচড়ের দাগের মত দেখতে পেলাম। খুব বেশি হলে বছরখানেক হতে পারে এই দাগের
বয়স। না হলে মদের তলানী কিংবা শ্যাওলার স্তরে ভরে যাবার কথা। আর এমনিতে
মারা যাওয়া কচ্ছপের হলে কোন দাগই থাকবার কথা না। নিশ্চিত হলাম যে এই
ঘূর্ণিঝড়ের ঠিক আগেই কেউ না কেউ জীবিত ছিলো এখানে।
দ্বিগুন
উৎসাহ নিয়ে সারা দ্বীপ চষে বেড়াতে লাগলাম আমি। কিছুদিন পর কেবল পাহাড়টাই
বাকী রইলো। আমার গন্তব্য এখন ওই পাহাড় আর সবশেষে পাহাড়ের চূড়ার দিকের
থিরুর গুহা।
১২পাহাড় চষাও শেষ হয়ে গিয়েছে।
বাদ আছে কেবল থিরুর গুহা। আজকে আমার লক্ষ্য সেটাই। সাধারণত পিস্তলটা নিয়ে
বের হই না। আজ কোন ঝুঁকি নিতে চাইলাম না। কি ভেবে যেন কোমরে গুঁজে নিলাম
পিস্তলটা। সেই পুরোনো দিনের মত ভোরের আলো ফুটবার সাথে সাথেই রওনা দিলাম
গুহার দিকে। একেবারে নিঃশব্দে পৌঁছে গেলাম গুহার মুখে। উঁকি দিয়ে দেখলাম
কোন সাড়া শব্দ নেই ভেতরে, একেবারে কোথাও কেউ নেই। তবে কেউ কিংবা কিছু মানুষ
যে এখানে থাকে অস্পস্ট পায়ের ছাপ আর উচ্ছিষ্ট খাবার গুহামুখের ধারে কাছে
ছড়িয়ে থাকতে দেখেই বুঝেছিলাম। কি ভেবে যেন ডাক দিলাম,
_ “কেউ আছো?”
বাংলায়
বলে উঠে নিজেই ভুল বুঝতে পারলাম। আগের ভাষা মনে করে আবার ডাক দিতে যাবো,
সে সময়ই পেছন থেকে কেউ আঘাত করলো মাথায়, আমি জ্ঞান হারালাম।
জ্ঞান
ফিরতেই দেখি আমাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। চোখ মেলে আশেপাশে মাথা ঘুরাতেই দেখলাম
কঙ্কালসার থিরুকে। দুটো ছোট বাচ্চা, কয়েকজন মধ্যবয়সী নারী আর এক তরুনীকে।
সবাই আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে আমার জ্ঞান ফেরার লক্ষণ দেখেই। থিরু
কাঁপাকাঁপা গলায় যা বললো তাতে বুঝলাম যে সে বলছে,
- “পিশাচটা জেগে উঠেছে।“ আমি সেই আদিম ভাষা যতটূকু মনে আছে তাতেই বললাম,
-
“আমি পিশাচ নই থিরু, আমি নিবু। এই পৃথিবীরই একজন সবল মানুষ”
থিরু জবাব দিলো,
-
“সব পিশাচই এমন বলে। এই পৃথিবীতে আমি ছাড়া আর কোন সবল মানুষ নেই। দশ আর
পাঁচ আঙ্গুল চক্র সময় আগে সব সবল মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সাংরার
অভিশাপে।“
আমি বুঝতে পারলাম কীসের কথা বলছে থিরু। এটাও বুঝতে
পারলাম সেদিনের সেই সুনামীতে এই গুহায় থিরুর সাথে থাকা নারীরা ছাড়া বাকী
সবাই মারা গেছে। আমার সর্বশেষ বাবা আর মাও সম্ভবত বেঁচে নেই। তরুও হয়তো
বেঁচে নেই। প্রচন্ড হতাশা ঘিরে ধরলো আমাকে। তবু বললাম,
- “আমি বেঁচে আছি থিরু। আমি এই পৃথিবীর সর্বশেষ সক্ষম সবল মানুষ, নিবু।“
থিরু বললো,
- “তুমি আমাদের ধোঁকা দিতে চাইছো অভিশপ্ত মানুষ। তুমি আমার থেকে আমার কাছে থাকা দুর্বল মানুষদের ছিনিয়ে নিতে এসেছো।”
আমি জবাব দিলাম,
-
“আমি কিছু ছিনিয়ে নিতে আসিনি থিরু। আমি আপনাদের উদ্ধার করে আসল পৃথিবীতে
নিয়ে যেতে এসেছি। এই পৃথিবীটা আসলে খুব সামান্য একটা অংশ, বাইরের পৃথিবী
অনেক অনেক বড়। আরো অনেক সুন্দর।“
থিরু রেগে গিয়ে বলে উঠলো,
-
“আমি বলেছিলাম একে হত্যা করতে। সব অভিশপ্ত মানুষের মত এও আমাদের লোভ
দেখাচ্ছে। এখনই একে হত্যা করো। অভিশপ্ত মানুষদের মাংস অনেক সুস্বাদু। কতদিন
অভিশপ্ত মানুষের মাংস খাইনি।”
মধ্যবয়সী নারী দুজন আমার দিকে
এগিয়ে আসলো। মাথার উপর পাথর উঠিয়ে নিয়ে আমার মাথা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারলো।
আমি কোনক্রমে গড়িয়ে সরে গেলাম। সেইসময় হুট করে তরুনীটি আমার সামনে এসে
দাঁড়ালো। অনুরোধ করলো আমাকে না মারতে। দুই নারীর সাথে তার কথাবার্তায়
বুঝলাম যে সেই দুই নারী তাকে বলছে থিরুর অবাধ্য হলে পরের জন্মেও দুর্বল
নারী হয়েই থাকতে হবে। সেই তরুনী আমার দিকে তাকালো। আমি আকুতি নিয়ে তার
চোখের দিকে চাইলাম। এই চোখ আমার খুব চেনা, এ তরুর চোখ। সময়ে চেহারা বদলে
যেতে পারে, চোখ নয়। আমি অস্ফুট স্বরে বললাম,
- “তরু, বিশ্বাস করো, আমি নিবু। অভিশপ্ত মানুষ নই। আমার বাঁধন খুলে দাও।“
তরু
দ্বিধান্বিত ছিলো। তবে বাকী দুই নারী আবার পাথর হাতে নিয়ে আমাকে মারতে
আসলে সে তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে আমার হাতের বাঁধন খুলে
দিলো। আমি বাকী বাঁধনগুলো দ্রুত খুলতে লাগলাম। তবে সেই সুযোগও মিললো না।
থিরুকে দেখলাম তার পাশে থাকা বিষাক্ত সূচ ছুড়বার ব্লো পাইপ মুখের কাছে
নিচ্ছে। আমি কোন রকম ঝুঁকি নিলাম না। আমার হাত কোমরের দিকে চলে গেলো
অজান্তেই। পিস্তলটা বের করে এনে পরপর বেশ কয়টা গুলি করলাম। নিথর হয়ে পড়ে
রইলো থিরুর দেহ। খোলা থাকা দুটো চোখের দৃষ্টিও স্থির, নিশ্চল। আমি বুঝতে
পারলাম বাকী দুইজন নারীও আমি থিরুকে হত্যা করবার পর যাই বোঝাই না কেন আর
বিশ্বাস করবে না। দীর্ঘদিনের জমে থাকা অন্ধ বিশ্বাস ভেঙে ফেলা খুব কঠিন।
মৃত্যুর পরও থিরু এদের কাছে একইরকম শক্তিশালী থেকে যাবে। এরা থিরুর হত্যার
প্রতিশোধ নিতে আমাকে মেরে ফেলে পরের জন্মে সবল মানুষ হয়ে জন্মাবার আশা
নিয়েই বেঁচে থাকবে।
সেই দুই নারীর একজন বর্শার মত আদিম অস্ত্র হাতে তরুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো আর একজন আমার দিকে তেড়ে আসছিলো। কোথায় যেন পড়েছিলাম,
“ইউ হ্যাভ টু বি ক্রুয়েল টু বি কাইন্ড” নিপুন
নিশানায় আমি প্রথমে আমার দিকে এগিয়ে আসা নারী আর এরপর তরুকে আক্রমণ করা
নারীর মাথা লক্ষ্য করে নিখুঁত নিশানায় গুলি করলাম। তরুকে কিংবা নিজেকে
রক্ষা করতেই আমাকে আবার পৃথিবীর ঘৃণ্যতম কাজটা করবার পথই বেছে নিতে হলো,
হত্যা যার নাম।
পরিশিষ্টমাসখানেক পেরিয়ে
গেছে। আগের ভাষা অনেকটাই মনে থাকবার কারণে এই অল্প সময়ের মধ্যেই তরুকে
অনেকটাই বাংলা শিখিয়ে ফেলেছি, আমাদের সাথে থাকা দুই দেবশিশুও খুব দ্রুতই
শিখছে। আমি এখন জানি তরুকে কীভাবে মধ্যবয়সী নারী দুইজন দাসীর মত ব্যবহার
করতো আর থিরুর কাছে তরু ছিলো কেবল ভোগের বস্তু। সভ্য সমাজে যাদের রক্ষিতা
বলা হয়। সাথের দুই নিস্পাপ দেবশিশুও খুব আগ্রহ নিয়ে অন্য পৃথিবীর গল্প
শোনে, ওরা তরুরই সন্তান। আমি ওদের বুঝিয়েছি আমি ওদের সর্বশেষ আর আসল বাবা।
আমি সত্যি ওদের আসল বাবা হতে চাই, মনে প্রাণেই চাই।
আমি ঠিক
করেছি কোন একসময় একেবারে এখানেই থেকে যাবো। তবে এর আগে আমাকে আমার মায়ের
কাছে ফিরতে হবে, ফিরতে হবে আমার পরিবারের কাছে। আমি সেই সময়ের কথা চিন্তা
করি। কল্পনায় দেখতে চাই শাড়িতে তরুকে ঠিক কেমন লাগবে! এই দেবশিশু দুটোকে
নতুন জন্ম দিতে হবে। ওরা দেখবে এমন এক পৃথিবী যে পৃথিবীতে কোন সবল, দুর্বল
কিংবা অভিশপ্ত মানুষ বলে কিছু নেই, কেবল মানুষ থাকে সেখানে। অচেনা অজানা
কারো জন্য বুক ভরা মায়া রাখতে পারা অনেক অনেক অনেক মানুষ। আমার মায়ের মত,
বাবার মত কিংবা ইরার মত। এই দুই দেবশিশুকে মা আমাকে যেভাবে প্রকৃত মানুষ
করে তুলেছেন সেভাবে গড়ে তুলতে হবে। তরুকে জানাতে হবে ভালোবাসার মানে ঠিক
কি। কতটা সুন্দর হতে পারে সেই ভালোবাসার পৃথিবী।
আমি অপেক্ষা করি
জাহাজ ফিরে আসবার। আমি জানি, কোন না কোন একদিন ওরা উঁকি দেবে এখানে। মানুষ
মানুষের প্রতি দ্বায়িত্ব এড়াতে পারে না, কখনোই না!
গল্পের পেছনের গল্পঃ আমার
জন্ম হয় যে বাসায়, সে বাসার মালিকের নাম ছিলো বাদশা মিয়া। আমার মা ডাকতেন
নানাজান বলে। আবার তার ছেলে মেয়েদের নাম ধরেই ডাকতেন। এই বাদশা মিয়ার জন্ম
বাংলাদেশে না। খুব সম্ভবত আফ্রিকার কোন এক দেশের বন্দরের কাছাকাছি কোন
এলাকায়। সময়টা দেশ ভাগের আগেই হবে, বাদশা মিয়া তখন ৫-৬ বছরের শিশু। কোন
কারনে উনার বাবা তাকে মারেন, আর সে কারনে বাদশা মিয়া অভিমান করে এক জাহাজে
গিয়ে লুকিয়ে থাকেন। ঘুম ভাঙ্গলে কিংবা একসময় দেখেন জাহাজ ছেড়ে দিয়েছে।
জাহাজের ক্যাপ্টেন এক ভারতীয় মুসলমান তাকে ভারতে নিয়ে আসেন এবং বড় করে
তোলেন, ফিরে যাবার যে উপায় ছিলনা।
একসময় উনি আবার পালক পিতার সাথে
রাগ করে আবার ঘর ছাড়েন। কলকাতায় চলে আসেন খুব সম্ভবত। সেখানে বাবুর্চির কাজ
করে বেশ নামডাকও অর্জন করেন। সেখানে তার পরিচয় হয় বাংলাদেশের চাঁদপুরের এক
তরুনীর সাথে। তাকে বিয়ে করে উনি বাংলাদেশে চলে আসেন।
তিনি এবং তার
সন্তানদের সবার চেহারা আফ্রিকানদের মত, চুলও কোঁকড়া। সেন্টিনেল আইল্যান্ড
সম্পর্কে একটা লেখা পড়বার সময় আমার মনে পরলো বাদশা নানার কথা। গল্প লেখার
শুরুও সেখান থেকেই। জীবন কত অদ্ভুত মোড় নিতে পারে উনিও তার এক প্রমান।